ইসলামোফোবিয়া হটাতে টরেন্টা সিটির প্রশংসনীয় উদ্যোগ
TORONTO – সম্প্রতি উত্তর আমেরিকা মহাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম ও কানাডার প্রধানতম নগরী সিটি অব টরন্টো কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব কার্যক্রম ‘টরন্টো ফর অল’-এর উদ্যোগে ১ লাখ ২০ হাজার ডলার ব্যয়ে অ্যাস্ট্রাল মিডিয়ার তত্ত¡াবধানে তিনটি বিশেষ ডিজিটাল পোস্টার শহরের সর্বত্র ১৪০টিরও বেশি টরন্টো ট্রানজিট কমিশনের (টিটিসি) বাস ও ট্রাম শেল্টারে এক মাসব্যাপি প্রদর্শন সম্পন্ন করেছে, যা নিয়ে আগ্রহদ্দীপক সাড়া জেগেছে। কারণ, বিষয়টি আজকের বিশ্বের অন্যতম আলোচনার বিষয় ‘ইসলামোফোবিয়া’ সংক্রান্ত।
কিন্তু এই ইসলামোফোবিয়াটি কী এবং কেন?
এক্ষেত্রে উইকিপিডিয়ায় একাধিক গবেষক ও পন্ডিতজনের অভিন্ন বক্তব্যটি হচ্ছে- Islamophobia is the fear of, hatred of, or prejudice against the religion of Islam or Muslims in general, especially when seen as a geopolitical force or a source of terrorism. অর্থাৎ ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে এক ধরণের ভয় কিংবা ঘৃণা অথবা সাধারণ অর্থে ইসলাম ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ, বিশেষত যখন তা দেখা হয় ভূরাজনৈতিকভাবে একটি সন্ত্রাসী শক্তি কিংবা উৎস হিসেবে।
আপাতদৃষ্টিতে এই ইসলামোফোবিয়ার উত্থান বিশ্ব কাঁপানো ‘নাইন-ইলেভেন’ সময়কালীন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরের সুউচ্চ টুইন- টাওয়ার ধ্বংসযজ্ঞের পর, যাতে নানা জাতিগোষ্ঠির নিরপরাধ তিন সহ¯্রাধিক মানুষ মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছে। সেই থেকে এই মুসলিম বিদ্বেষ বা ঘৃণা বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে গেছে। ফলশ্রæতিতে অনেক মুসলমানই এক দোটানায় তাদের প্রিয় নবী মোহাম্মদ (দঃ)-এর নামটিও নিজেদের নাম থেকে পরিহার করেছে। অথচ তা কতখানি তাদের মুসলিম মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করেছে, সেটাই তারা অনবহিত। কেননা ইসলাম ধর্মের অনুসারী হিসেবে তাদের নবীই হচ্ছেন তাদের পারলৌলিক জীবনের পাথেয় ও আরাধ্য, এমনকী মোহাম্মদ নামটি পৃথিবীতে সর্বাধিক প্রচলিত।
প্রসঙ্গত টরন্টো সিটির ‘টরন্টো ফর অল’ কার্যক্রমের অধীনে যে তিনটি বিশেষ ডিজিটাল পোস্টারের বিষয়ে মনোনিবেশ করা যাক। এতে টরন্টো সিটি তাদের ওয়েবসাইটে জানিয়েছে, দৃশ্যত যারা নিজেদের মুসলিম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন, তাদেরকে টার্গেট করেছে ইসলামোফোবিয়া। ইসলামোফোবিয়া হচ্ছে মুসলিমদের নিয়ে ভয় কিংবা ঘৃণাপোষণ। এই ঘৃণা ও ভয় যারা মুসলিম হিসেবে নিজেদের পরিচয় দেন, তাদের প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিষ্পেষণ ও বিদ্বেষের প্রতিফলন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামোফোবিয়া বর্ণবিদ্বেষ ও অভিবাসী বিরোধী চেতনার রূপক এবং তা গৎবাঁধা লিঙ্গ বৈষম্যের পরিচায়ক। ২০২১ সালের জরিপ অনুসারে টরন্টোয় ৯ দশমিক ৬ শতাংশ জনগোষ্ঠির পরিচয় মেলে তারা মুসলিম। সেজন্য আসুন কোনো ভিন্নতা ব্যতিরেকে তাদেরকে গ্রহণ করি। একত্রে আমরা এই নগরী থেকে সেই ঘৃণা ও বৈষম্যের উৎপাটন ঘটাই।
এই অমোঘ বার্তারই প্রতিফলন যথাক্রমে বিশ্বাস, প্রার্থনা ও হিজাব – এই তিন আঙ্গিকে পৃথক ডিজিটাল পোস্টারে বিমূর্ত হয়েছে।
তাতে সুনিপুণভাবে তারকাচিহ্ন দিয়ে আহবান জানানো হয়েছে। যেমন- বিশ্বাসের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, টরন্টোবাসী সমাদর করে সংস্কৃতি*।
সেটাই সেখানে তারকাচিহ্ন দিয়ে পরের লাইনে এসেছে- *কিন্তু তারা সমাদর করে না তার মুসলিম বিশ্বাসকে। প্রার্থনার ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, টরন্টোবাসী আলিঙ্গণ করেছে বৈচিত্র্য*; *কিন্তু আলিঙ্গণ করেনি তার প্রার্থনার সময়। তদ্রæপ হিজাবের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে- টরন্টোবাসী স্বাগত জানিয়েছে সবাইকে*; *কিন্তু স্বাগত জানায়নি হিজাবকে। আর এই তিনটি পোস্টারের শেষ গুরুত্ববহ অভিন্ন লাইনটি হচ্ছে- আসুন কোনো ভিন্নতা ব্যতিরেকে তা গ্রহণ করি।
এক চমৎকার ও উদার মননেরই প্রতিফলন এবং আবাহন বটে! আর এই প্রচারণায় ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস-এর সঙ্গে পরামর্শক হিসেবে যুক্ত হয়েছে- আফগান উইমেন্স অর্গানাইজেশন, আগা খান মিউজিয়াম, আরব কমিউনিটি সেন্টার অব টরন্টো, কানাডা মুসলিম কাউন্সিলিং, কানাডিয়ান কাউন্সিল অব মুসলিম উইমেন, হিজাবি বলার্স, ইসলামিক রিলিফ কানাডা, ওসিএএসআই, সে সোমালি, স্মাইল কানাডা, সিরিয়ান কানাডিয়ান ফাউন্ডেশন, টরন্টো প্যালেস্টাইন ফিল্ম ফেস্টিভাল ও আরবান অ্যালায়েন্স অন রেস রিলেশন্স।
এ বিষয়ে সিটি অব টরন্টোর মিডিয়া রিলেশন্স কর্মকর্তা ব্রেডলি বোমবেরি-কে যোগাযোগ করা হলে নানাবিধ প্রশ্নাত্তরের সঙ্গে অভিমত প্রকাশ করে বলেন, টরন্টো সিটি কাউন্সিলের অনুমোদনে টরন্টো ফর অল একটি দীর্ঘমেয়াদী কার্যক্রম এবং এই উদ্যোগটি কমিউনিটি পার্টনার ও সংগঠন সমূহের পরামর্শ ও সমর্থনে ১৩তম প্রয়াস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। টরন্টো ফর অল কার্যক্রমের লক্ষ্য হচ্ছে জনসচেতনতার পাশাপাশি টরন্টোবাসীর মাঝে আলোচনার পরিব্যাপ্তি ঘটানো, যাতে নগরবাসী সকল ধরণের বৈষম্য ও বর্ণবিদ্বেষকে প্রত্যাখ্যান করে। আগের প্রচারণাগুলোতে স্থান পেয়েছে যথাক্রমে- অ্যান্টি-ইস্ট ইন্ডিয়ান রেসিজম, অ্যান্টি বø্যাক রেসিজম, অ্যাজিসম ও অ্যান্টি সেমিটিজম, যার সবগুলোই সিটির এ সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে দৃশ্যমান।
অপরদিকে উদ্যোক্তা সংগঠন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব কানাডিয়ান মুসলিমস-এর পক্ষে মিডিয়া কর্মকর্তা ফাতেমা আবদাল্লা বলেন, আমরা আশাব্যঞ্জক সাড়া পেয়েছি, তথাপি মূল্যায়ণ কর্তৃপক্ষ সিটি অব টরন্টো এ বিষয়ে উপযুক্ত উত্তর প্রদানে সক্ষম। এই পোস্টারগুলো সম্পর্কে অপরাপর ধর্মীয় গোষ্ঠির অভিমতের ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই; তবু প্রত্যাশা করি বৃহত্তর জনগোষ্ঠির জন্য তা শিক্ষণীয় উদ্দেশ্য পরিপুরণ করেছে।
Pic from https://www.toronto.ca/community-people/get-involved/community/toronto-for-all/islamophobia/